কারওয়ান বাজারে হামলায় "চাঁদাবাজির হাল ধরা" সেই যুবদল নেতার অনুসারীরা
“বিগত দিনে যে চাঁদাবাজেরা ছিল, তারা তো আসেনি। এটার হাল তো ধরতে হবে। আমরা ২০–২৫ জন মিলে এটার হাল ধরেছি।”
যমুনা টিভিতে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় অবলীলায় কথাগুলো বলছিলেন আব্দুর রহমান। সাক্ষাৎকারেই নিজের পরিচয় দেন তেজগাঁও থানা যুবদলের সদস্য সচিব হিসেবে। গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর যমুনা টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ইনভেস্টিগেশন ৩৬০ ডিগ্রি অনুষ্ঠান; ইউটিউবে যেটির শিরোনাম ছিল, “বিগত চাঁদাবাজরা তো আসেনি, এটার হাল তো ধরতে হবে: যুবদল নেতা”।
কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজি সংক্রান্ত এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে কিভাবে ৫ আগস্টের পর আব্দুর রহমান এবং তার সহযোগীরা বিগত আওয়ামী লীগ আমলের চাঁদাবাজির দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
যমুনা টিভিকে আব্দুর রহমান আরও বলেছিলেন, “আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ—ওরা এককভাবে চাঁদাবাজিগুলো করত এবং এর ভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত যেত।”
এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে যুবদল।
আজ সোমবার সকালে কারওয়ান বাজারের সাধারণ ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে একটি মানববন্ধন আয়োজন করেন। সেখানে ব্যবসায়ীদের হাতে থাকা ব্যানারে আব্দুর রহমানের নাম ও ছবি ছিল।
দ্য ডিসেন্ট যমুনা টেলিভিশনে প্রচারিত ওই ভিডিও এবং মানববন্ধনের ব্যানারে ব্যবহৃত নাম ও ছবি বিশ্লেষণ করে এবং বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে উভয় ‘আব্দুর রহমান’ একই ব্যক্তি।
ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ দ্য ডিসেন্টকে বলেন, “থানা কমিটির সদস্য সচিব হয়েও তিনি গণমাধ্যমে সঠিকভাবে বক্তব্য দিতে পারেননি এবং দলকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। এজন্য তাকে তখন বহিষ্কার করা হয়।”
আজকের মানববন্ধনে অংশ নেয়া কয়েকজন ব্যবসায়ী দ্য ডিসেন্টকে বলেছেন, তারা মূলত আব্দুর রহমানের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে মানববন্ধনে অংশ নিয়েছিলেন। তবে মানববন্ধনের এক পর্যায়ে একদল লোক এসে তাদের ওপর হামলা চালায়। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এই হামলায় জড়িতরা মূলত তেজগাঁও থানা যুবদলের বহিষ্কৃত সদস্য সচিব আব্দুর রহমানের অনুসারী।

হামলায় আহত এক ব্যবসায়ী
কারওয়ান বাজারের ইসলামিয়া শান্তি সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক বেলায়েত হোসেন এই মানববন্ধনে হামলায় অন্তত ১০ জন ব্যবসায়ীর আহত হওয়ার কথা জানান। “কারওয়ান বাজারের সব ব্যবসায়ী আব্দুর রহমানের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। সে পুলিশের সামনেই আজ আমাদের মারছে। তার কতটা ক্ষমতা, তা বুঝতেই পারছেন।” তিনি বলেন
বেলায়েত হোসেনের দাবি, ৫ আগস্টের আগে আব্দুর রহমানকে কখনো কারওয়ান বাজারে দেখা যায়নি। তবে ৫ আগস্টের পর তিনি অন্তত ৫ থেকে ৭টি দোকান কিনেছেন এই মার্কেটে।
বহিষ্কারের পরও কমেনি আব্দুর রহমানের দৌরাত্ম্য
গত বছর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও একটুও কমেনি আব্দুর রহমানের চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য- এমনটাই জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ করে চলতি মাসে কারওয়ান বাজারের ৫৫০ জন ব্যবসায়ী লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইসলামিয়া শান্তি সমিতির কাছে।
অভিযোগকারীদের একজন ৫৩ বছর বয়সী মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি ৩৫ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করছেন। কিচেন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় তার মুদির দোকান নোয়াখালী স্টোর। দেলোয়ার হোসেনের অভিযোগ, গত বছরের শেষের দিকে আব্দুর রহমান তার কাছে ১৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন।

যুবদল থেকে বহিষ্কারাদেশ
তিনি জানান, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি কারওয়ান বাজারের কাঠপট্টিতে তাকে ডেকে নেওয়া হয়, যেখানে বিএনপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি চলছিল। সেখানে আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে তাকে গণধোলাই দেওয়া হয়।
“এই ঘটনায় আমি কোনো মামলা করতে পারিনি। কারণ থানা পুলিশ পুরোপুরি তার নিয়ন্ত্রণে,” বলেন দেলোয়ার হোসেন।
একই মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী মো. বেলায়েত হোসেন (৪০) বলেন, তিনি ২৫ বছর ধরে কারওয়ান বাজারে ব্যবসা করছেন। কয়েক মাস আগে আব্দুর রহমান তার কাছেও চাঁদা দাবি করেন। বেলায়েতের ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে বলা হয়—রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন, তাই টাকা দিতে হবে।
বেলায়েত হোসেন জানান, “এর কয়েক দিন পর এক রাতে দোকান বন্ধ করে বের হলে সামনের রাস্তায় আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০ থেকে ৮০ জন আমার ওপর হামলা চালায়। পরে অন্য ব্যবসায়ীরা আমাকে উদ্ধার করে মার্কেটের ভেতরে নিয়ে আসে। কিন্তু হাসপাতালে নিতেও বাধা দেওয়া হয়।”
তবে এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবদলের সদস্য সচিব সাজ্জাদুল মিরাজ দ্য ডিসেন্টকে বলেন, “আমরা আব্দুর রহমানের চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করেছি। তবে তার বিরুদ্ধে সঠিক কোনো অভিযোগ পাইনি। আজ যারা মানববন্ধন করেছেন, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের অনেকের সঙ্গে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি দেখা গেছে।”
পুলিশ কী বলছে?
তেজগাঁও থানার ওসি কৌশৈন্যু মারমা দ্য ডিসেন্টকে বলেন, “মামলা করলে মামলা নেওয়া হবে। আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তবে তিনি সবগুলোতেই জামিনে আছেন। মামলা ছাড়া আমরা কিছু করতে পারি না।”
চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে থানা পুলিশের কোনো উদ্যোগ আছে কি না — এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমাদের ইন্টেলিজেন্স কাজ করে। তবে এ ধরনের তেমন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। আজকের ঘটনায় আমরা ব্যবসায়ীদের মামলা করার কথা বলেছি।”