রাজাকারের তালিকায় জামায়াতের মাত্র ৩৭ জন থাকার পুুরনো অসত্য নতুন করে প্রচার
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে জামায়াত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইডি থেকে ”আওয়ামীলীগ সরকার কতৃক প্রকাশিত ১০ হাজার রাজাকারের তালিকায় আওয়ামীলীগের ৮০৬০ জন, বিএনপির ১০২৪ জন ও জামায়াতে ইসলামীর মাত্র ৩৭ জন রাজাকারের নাম ছিল” শীর্ষক দাবিটি প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া কয়েকটি টকশোতেও বেশ কয়েকজন অতিথি এই দাবিকে ’তথ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, আওয়ামীলীগের করা তালিকার ভিত্তিতে ’আওয়ামীলীগই সবচেয়ে বড় যুদ্ধাপরাধী এবং রাজাকারের দল’ এবং এর বিপরীতে ’জামায়াতে রাজাকারের সংখ্যা সবচেয়ে কম’। এ ধরণের পোস্ট দেখুন এখানে ও এখানে।

অসত্য দাবি সম্বলিত ফেসবুক পোস্টের স্ক্রিনশট | ফেসবুক
জিটিভিতে ”কেমন বার্তা দিলো জামায়াতের সমাবেশ” শিরোনামে গত ১৯ জুলাই প্রচারিত হওয়া একটি টকশোতে এবি পার্টির নেতা ব্যারিস্টার এবি ফুয়াদ “জামাত-শিবির রাজাকার, এই মূহুর্তে বাংলা ছাড়” স্লোগানের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলেন, (ভিডিওটির ১৭ মিনিট ৪৪ দ্রষ্টব্য), “রাজাকার জিনিসটা তো একটি অক্সিলিয়ারি ফোর্স, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় একটি অর্ডিনেন্স জারি করে ফোর্সটা বানিয়েছে।…আওয়ামী লীগের সময়ে রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিলো। এর ভিতর ৮ হাজার+ হলো আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে জড়িত, ২ হাজার সামথিং বিএনপির রাজনীতি করে, জাতীয় পার্টির কটা আছে এবং দেখলাম জামায়াতের আছে ৩৫ কী ৩৭ জন।”
২৯ আগস্ট একুশে টেলিভিশন জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারী ড. রেজাউল করীমের একটি শর্ট ভিডিও প্রকাশ করে ফেসবুকে, যার ক্যাপশনে লেখা ছিলো ‘১০ হাজার রাজাকারের তালিকায় বিএনপি দ্বিতীয় অবস্থানে’।
ভিডিওটিতে ড. রেজাউল করীম বলেন, “আওয়ামী লীগ যে দশ হাজারের তালিকা করেছিলো, দ্বিতীয় অবস্থানে তো আপনারা (বিএনপি)। তালিকায় আওয়ামী লীগের ৮ হাজার ৩০০ কত জন, আপনারা (বিএনপি) ২০০ আর আমরা (জামায়াতে ইসলামী) ৩৭ জন।”
এছাড়া জিটিভির নাটাই সুতো কার হাতে শিরোনামে ৪ সেপ্টেম্বর ইউটিউবে প্রচারিত হওয়া টকশোতে ভিডিওটির ৩৬ মিনিট ২০ সেকেন্ডে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা দক্ষিণের নায়েবে আমীর হেলাল উদ্দীন বলেন, “আওয়ামী লীগ ১০ হাজার রাজাকারের তালিকা দিলো। সেখানে ১ নাম্বারে থাকলো আওয়ামি লীগ, দুই নাম্বারে থাকলো বিএনপি, তিন নাম্বারে জাতীয় জাতীয় পার্টি এবং লাস্ট নাম্বার হলাম আমরা জামাত ইসলামী”
যদিও এখানে কোনো সংখ্যার উল্লেখ করেননি তিনি।
এই দাবিটি এবারই প্রথম প্রচার করা হচ্ছে তা নয়। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক রাজাকারের একটি তালিকা প্রকাশ করার পর বিভিন্ন সময় জামায়াত সংশ্লিষ্টরা এই দাবিটি করে আসছেন, সামাজিক মাধ্যমে এটি একাধিকবার ভাইরাল হয়েছে।
২০১৯ সালে রাজাকারের (প্রত্যাহারকৃত) সরকারি তালিকা: কোন দলের কতজন? শিরোনামে BD Factcheck নামক ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান রাজাকারদের দলীয় পরিচয় নিয়ে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে।
ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে আর না থাকলেও তাদের প্রতিবেদনটি ফেসবুকে পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর Muktiforum নামক একটি পেইজে প্রতিবেদনটি পোস্ট করা হয়। BD Factcheck এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক কদরুদ্দীন শিশির (বর্তমানে দ্য ডিসেন্ট এর সম্পাদক) উক্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনটি সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন।
দ্য ডিসেন্ট যাচাই করে দেখেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের তালিকা মতে ’জামায়াতে ইসলামীতে মাত্র ৩৭ জন রাজাকার ছিলেন’ বলে যে দাবি ছড়ানো হয়েছে সেটি অসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বরে বিগত সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের হয়ে ভূমিকা পালনকারী হিসেবে যে ১০ হাজার ৭৮৯ জন ’রাজাকারের তালিকা’ প্রকাশ করে সেখানে বেশিরভাগ ব্যক্তিরই দলীয় পরিচয় দেওয়া হয়নি।
যদিও নানান বিতর্কের মুখে ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বরেই একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রত মন্ত্রী মোজাম্মেল হক তালিকাটি প্রত্যাহার করে নিয়ে জানান যে, সংশোধিত তালিকা ২০২০ সালে ২৬ মার্চ প্রকাশ করা হবে। তবে, পরে আর কোনো সংশোধিত তালিকা প্রকাশ করা হয়নি।
দলীয় পরিচয় নিয়ে নানান অসঙ্গতি
রাজাকারদের দলীয় পরিচয় নিয়ে যে দাবিগুলো প্রচার করা হয়েছে যাচাই করতে গিয়ে এসব দাবির নানান অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, প্রকাশিত তালিকায় ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নাম থাকলেও প্রচার হওয়া দাবিগুলোতে বিভিন্ন দলের রাজাকারের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তার যোগফল দাঁড়ায় ১০ হাজার। অর্থাৎ, প্রচারিত দাবিগুলোতে বাকি ৭৮৯ জন কোন দলের তার কোন হিসাব পাওয়া যায় না।
সামাজিক মাধ্যমে ১০ হাজার জনের দলীয় পরিচয়ের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে এসব দলীয় পরিচয় কোথায় কিভাবে পাওয়া গেছে তার কোনো তথ্যসূত্র পাওয়া যায় না। যদিও প্রকাশিত তালিকায় বেশিরভাগ ব্যক্তিরই দলীয় পরিচয় দেয়া নেই।
সরকার প্রকাশিত ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকাতে আমরা এসব ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। প্রকাশিত তালিকায় বিভাগ ভিত্তিক স্বাধীনতাবিরোধীদের ও দালাল আইনে মামলা রুজু হওয়া ব্যক্তিবর্গের সবার দলীয় পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। ফলে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের সবার রাজনৈতিক পরিচয় এই তালিকা থেকে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে সরকার প্রকাশিত তালিকার পিডিএফ ভার্সনে ৫০৮ থেকে ৫৬৩ পৃষ্ঠাজুড়ে ১৯৭১ সালে শূন্য ঘোষিত আসনসমূহের উপনির্বাচনে মনোনয়নের জন্য আবেদনকারী এবং প্রার্থীদের নাম প্রস্তাবকারক ও সমর্থনকারী ৮১৭ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ রয়েছে। এই ৮১৭ জনের একাংশের নামের পাশে দলীয় পরিচয়ও উল্লেখ করা আছে।
এই ৮১৭ জনের যাদের নামের পাশে দলীয় পরিচয় দেয়া আছে তাদের মধ্যে অন্তত ৭৮ জনের নামের পাশে 'জামায়াতে ইসলামী'র পরিচয় উল্লেখ আছে দেখতে পাওয়া যায়। দলীয় পরিচয় লেখার ক্ষেত্রে 'জামায়াতে ইসলামী' এর নাম বিভিন্ন বানানে ও সংকেতে লেখা হয়েছে।
এর মধ্যে ৩৭ জনের নামে পাশে ইংরেজি বর্ণে 'JI' লেখা রয়েছে। বাকিদের নামের পাশে "J.I.", "Jamaat-e-Islam", "Jamaat-e-Islami", "J. Islam", "Jamat Islam", "Zamate Islam", "Jamat-i-Islami" ইত্যাদি বানানে দলের পরিচয় লেখা রয়েছে।
যাচাইয়ে দেখা যায়, ৮১৭ জনের মধ্যে এমন ব্যক্তিও রয়েছেন যিনি জামায়াতে ইসলামী প্রখ্যাত নেতা হওয়ার পরেও তালিকায় তার নামের পাশে দলীয় পরিচয় উল্লেখ নেই।
যেমন- জামায়াত নেতা ও একাত্তরের মালেক মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ও দলটির সাবেক নায়েবে আমীর মাওলানা একেএম ইউসুফ (দালাল আইনে মামলা হয়েছিল, পরবর্তীতে ট্রাইবুনালে বিচারাধীন অবস্থায় মারা যান)। ৮১৭ জনের তালিকায় তার নাম ৮৪ নম্বরে আছে, তবে তার দলীয় পরিচয় উল্লেখ নেই।
আবার এই ৮১৭ জনের তালিকাতেই এক ব্যক্তির নাম একাধিকবারও এসেছে। জামায়াতের অন্তত তিনজন নেতার নাম দুইবার এসেছে । এই তিন নেতা হলেন দলটির সাবেক আমীর মকবুল আহমদ, সাবেক আমীর গোলাম আযম, এবং দিনাজপুরের এডভোকেট আব্দুল কাশেম।
এছাড়া ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকায় এই ৮১৭ জনের বাইরেও জামায়াতে ইসলামী সংশ্লিষ্ট লোকজনের নাম রয়েছে। সরকারি ডকুমেন্টটির পিডিএফ-এ জামায়াতে ইসলামীর নামকে বিভিন্ন ইংরেজি কীওয়ার্ডে লিখে সার্চ দিলে আরও বেশ কয়েকজনের দলীয় পরিচয় 'জামায়াতে ইসলামী' হিসেবে উল্লেখ রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়।
ভাইরাল হওয়া ফেসবকু পোস্টগুলোতে ১০২৪ জনকে "বিএনপি (ধানের শীষ)" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অথচ বিএনপির জন্ম ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ফলে ৭১ সালে কোনো ব্যক্তির বিএনপির হয়ে 'রাজাকার' এর ভূমিকা পালনের সুযোগ ছিল না।
বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর বিএনপিতে যোগ দেয়ার কারণে যদি এসব ব্যক্তিকে 'বিএনপির রাজাকার' হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্যদের বেলায় কী ঘটেছে তারও কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। অর্থাৎ, যাদেরকে 'আওয়ামী লীগের রাজাকার' বা 'জামায়াতে ইসলামীর রাজাকার' বলে দলীয় পরিচয় দেয়া হয়েছে তাদের কোন সময়কার দলীয় অবস্থানের কারণে কারণে তাদেরকে নির্দিষ্ট দলের রাজাকার হিসেবে পরিচয় নির্ধারণ করা হয়েছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত খুঁজে পাওয়া যায় না এসব দাবিতে বা সরকারের তালিকাতে।
তালিকাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট কতজন ব্যক্তি রয়েছেন তারও কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়ার সুযোগ নেই। পিডিএফ-এ আওয়ামী লীগের নাম দিয়ে সার্চ দিলে মাত্র ৫ জনের নামের পাশে "আওয়ামী লীগ" লেখা পাওয়া যায়।
ফলে আলোচ্য সরকারি তালিকায় জামায়াতের ইসলামীর মাত্র ৩৭ জনের নাম থাকার দাবিটি যেমন ভুল, তেমনি বাকি দলগুলোর ব্যাপারে যেসব সংখ্যা বলা হচ্ছে সেটিও ভিত্তিহীন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ও পরে প্রত্যাহ্যার করা তালিকাটি দেখুন এখানে।